করোনা ডায়েরী : ঘাতক করোনার অভদ্র শিষ্টাচার!

  • ১ম পর্ব : ঘাতক করোনার অভদ্র শিষ্টাচার!

অধ্যাপক আকতার চৌধুরী ◑

হঠাৎ একটা নতুন শব্দ । করোনা ভাইরাস – কোভিড ১৯ ।নিমেষেই বদলে যাওয়া পৃথিবী। নি:শ্বাসে বিশ্বাস হারাল বিশ্ববাসী। লক ডাউন। আমাকে বাঁচতে হবে। জান নিয়ে ছুটোছুটি । আতংক চারিদিকে। মানুষের মুখে মুখে ‘করোনা’ । হাতে গ্লাভস , মুখে মাস্ক , সেনিটাইজার , সাবান , হাত ধোয়া। যে গুলো ক’দিন আগেও মানুষ খুজত না । বাঁচার তাগিদে পড়ে গেল কাড়াকাড়ি , বাড়াবাড়ি । সুযোগ বুঝে ব্যবসায়িদের পোয়াবারো। ধারণা অতিরিক্ত মুনাফার টাকা দিয়ে করোনাকে বশ মানাবে। অথচ প্রতিদিন আমার যে মুখটা নিয়ে বসবাস তাকে ধরাও যাবেনা , ছোঁয়াও যাবেনা । চোখে বালি পড়লে আঙ্গুল দিয়ে একটু কচলাতেও পারবনা । যদি হাত অপরিস্কার হয় । এমন শর্তে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ পতন ঘটে । বিচ্ছিন্ন বিশ্ব । করোনার কঠিন শিষ্টাচার!

আদব কায়দায় অভাবনীয় পরিবর্তন । সালাম , আদাব , নমস্কার দিয়েছেন তো , হ্যান্ডশেক করা যাবেনা । কোলাকুলি করা যাবেনা ।আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরা যাবেনা । চুমো খাওয়া যাবেনা । যেখানে একজন মা শিশুথেকে ১ ইঞ্চি দুরত্বেও থাকতে পারবেনা সেখানে সামাজিক দুরত্ব ২ মিটার। ঘরের দরজার মেহমানকে দরজা থেকে বিদায় দিতে হবে। চলে যাওয়ার পর অস্পৃশ্যের মত তার হাটাপথে জীবাণু নাশক ছিটাতে হবে। কারো সাথে হাত মিলিয়েছেন তো সে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। করোনা ভাইরাস হিন্দু চিনে না , মুসলিম চিনে না , বৌদ্ধ চিনে না , খ্রীষ্টান চিনে না । তার কাছে জাত পাতের বালাই নেই । যেন চীনা ভাইরাস কাউকে চিনে না । দুনিয়াতে প্রথম দেখলাম ডাক্তার রোগী দেখলে ভয়ে পালায়। জ্বর , হাচি, কাশিতে আত্মীয় স্বজন পালায় । বিদেশ ফেরত স্বামী এলে বউ পালায় । সবায় পলায়ন পর। এ যেন ছোটখাট কেয়ামতের মডেল টেষ্ট !

জীবনের তাগিদে ঘরের বাইরে কাটানো মানুষদের বলা হল ঘরে আবদ্ধ থাকতে। শিক্ষা প্রতিস্ঠান ,হাট-বাজার , গাড়ি ঘোড়া ,দোকান পাট কিন্তু উপায় নেই- বাঁচতে হলে, মানতে হবে।এ যেন আমাদের চির পরিচিত হরতালের আধূনিক সংস্করণ , যা বিরোধীদল করেনা সরকারই বাধ্য করে। অপরাধীরা ঘরে থাকতে পারত না , এখন ঘরে না থাকাটাই অপরাধ। রাস্তা দিয়েছে মানুষের চলাফেরার জন্য , অথচ সে রাস্তায় মানুষ চলাচল নিষিদ্ধ। যে টাকা ছাড়া জীবন অচল , এখন ধরলেই জীবন বিকল।

প্রাণ সংহারি করোনার যেন কোন ঔষধই নাই । করোনার অঙ্গে ১৯৮ রুপ। ফলে যে যার প্রাণ নিয়ে বাঁচার তাগিদ । এক করোনায় স্বামী স্ত্রী বাবা মা ভাইবোন আত্মীয় স্বজনের সম্পর্ক পর্যন্ত ছিন্ন ভিন্ন । করোনা আক্রান্ত রোগীর লাশ প্রিয়জনের হাতের পরশে শেষ গোসলটাও পেল না। কফিন মানুষের কাধে না উঠে ক্রেনে চড়ল। হাচি কাশি শিষ্টাচারের চেয়ে কঠিন করোনা শিষ্টাচার! এ এক ভিন গ্রহে প্রবেশের মত। এখন সবার মনে প্রশ্ন করোনা পরবতী বিশ্ব কেমন হবে?

সম্প্রতি নতুন নতুন শব্দ আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাড়াল। আইসোলেশন , কোয়ারেন্টাইন , হোম কোয়রান্টিন , লকডাউন। ‘কোয়ারেন্টাইন’। যদিও বা আমরা যারা কম্পিউটার আর অনলাইনের সাথে বসবাস তাদের কাছে এটা কোন নতুন শব্দ নয় । যারা এন্টিভাইরাস ইউজ করেন তাদের এটা জানা বিষয়। যখন ভাইরাসটাকে নির্মুল করা যাবে না তাকে একটা জায়গায় আবদ্ধ করার নামই ‘কোয়ারেন্টাইন’।কিন্তু করোনা থেকে রক্ষা পেতে এ কোয়ারেন্টাইনের ধারণা দাড়াল অন্য রুপে। ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ মানে ১৪ দিন আপনাকে একটি ঘরে আবদ্ধ থাকতে হবে। লোকজনের সাথেও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে।যত্রতত্র হাচি কাশি দেয়া যাবেনা । এছাড়াও ‘আইসোলেশন’ শব্দটিও খুবই আলোচিত। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এ শব্দ প্রযোজ্য ।

এসব শব্দগুলোর বিষয়ে অভিজ্ঞজনেরা কি বলেন একটু দেখি –

আইসোলেশন: কোনও ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তা ধরা পড়লে তাকে আইসোলেশনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। আইসোলেশনের সময় চিকিৎসক ও নার্সদের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে থাকতে হয় রোগীকে। অন্য রোগীদের কথা ভেবে হাসপাতালে আলাদা জায়গা তৈরি করা হয় এদের জন্য। অন্তত ১৪ দিনের মেয়াদে আইসোলেশন চলে। অসুখের গতি-প্রকৃতি দেখে তা বাড়ানোও হয়। আইসোলেশনে থাকা রোগীর সঙ্গে বাইরের কারও যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। তাদের পরিজনের সঙ্গেও এই সময় দেখা করতে দেওয়া হয় না। একান্ত তা করতে দেওয়া হলেও অনেক বিধি-নিষেধ মেনে।

কোয়ারেন্টাইন: করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পরই তার উপসর্গ দেখা দেয় না। অন্তত সপ্তাহখানেক সেটি ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তাই কোনও ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশ থেকে ঘুরে এলে বা রোগীর সংস্পর্শে এলে তার শরীরেও বাসা বাঁধতে পারে কোভিড-১৯। তিনি আক্রান্ত কিনা এটা নিশ্চিত হওয়া মাত্রই কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয় রোগীকে। অন্য রোগীদের কথা ভেবেই কোয়ারেন্টাইন কখনও হাসপাতালে আয়োজন করা হয় না। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে এমন ব্যক্তিকে সরকারি কোয়ারেন্টাইন পয়েন্টে রাখা হয়।
কমপক্ষে ১৪ দিনের সময়সীমা এখানেও। এই সময় রোগের আশঙ্কা থাকে শুধু, তাই কোনও রকম ওষুধপত্র দেওয়া হয় না। শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়। বাইরে বেরনো বন্ধ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। যেহেতু রোগের জীবাণু ভিতরে থাকতেও পারে, তাই মাস্ক ব্যবহার করতেও বলা হয়। বাড়ির লোকেদেরও এই সময় রোগীর সঙ্গে কম যোগাযোগ রাখতে বলা হয়।

হোম কোয়রান্টিন: বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়িতে রেখে আইসোলেশন সম্ভব নয়। বরং একে হোম কোয়ারেন্টাইন বলাটা অনেক যুক্তিযুক্ত। কোনও ব্যক্তি যখন নিজের বাড়িতেই কোয়ারেন্টাইনের সব নিয়ম মেনে, বাইরের লোকজনের সঙ্গে ওঠা-বসা বন্ধ করে আলাদা থাকেন, তখন তাকে হোম কোয়ারেন্টাইন বলে। সাধারণত, সম্প্রতি আক্রান্ত দেশ থেকে ঘুরে না এলে রোগীকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।এক্ষেত্রেও ন্যূনতম ১৪ দিন ধরে আলাদা থাকার কথা। কোনও ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশ থেকে ঘুরে এলে, বা রোগীর সংস্পর্শে এলে তার শরীরেও বাসা বাঁধতে পারে কোভিড-১৯। বাসা আদৌ বেঁধেছে কি না বা সে আক্রান্ত কিনা এটা বুঝে নিতেই এই ব্যবস্থা নিতে হয়।
এক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যবিধির বাইরে কোনও আলাদা ওষুধ দেওয়ার প্রশ্নই নেই। বেশি করে পানি, ভাল করে খাওয়া-দাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর নানা পথ্য— এসব দিয়েই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।

লকডাউন : লকডাউন বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভবনগুলির ক্ষেত্রে, একটি আংশিক লকডাউন অর্থ হচ্ছে ভবনটির বাইরের দিকের দরজাগুলি লক করা আছে এবং লোকেরা বিল্ডিংয়ের বাইরে প্রস্থান বা প্রবেশ করতে পারবে না। একটি সম্পূর্ণ লকডাউন এর মানে হল যে লোকেরা যেখানেই থাকুক না কেন থাকতে হবে এবং শ্রেণীকক্ষ, অ্যাপার্টমেন্ট ইউনিট, স্টোর ইউনিট, অফিস স্পেস, কনডো ইউনিট অথবা বিল্ডিং এ প্রবেশ বা প্রবেশ করতে পারবে না। যদি মানুষ একটি hallway হয় তারা নিকটতম ক্লাসরুমে, অ্যাপার্টমেন্ট ইউনিট, কন্ডো ইউনিট, অফিস স্পেস বা দোকান ইউনিট মধ্যে যেতে হবে।

লক ডাউন কী? এ সময় কি করবেন, কি করবেন না
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে সারাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ন্যায় বাংলাদেশের একাধিক জায়গায় লক ডাউন শুরু করেছে সরকার। অনেকেই জানেন না, লক ডাউন মানে কী? লক ডাউন হলে কী করবেন, কী করবেন না?
লক ডাউন ঘোষণা করা হলে ঘোষিত নির্ধারিত সময় থেকে জরুরি পরিষেবা ছাড়া সমস্ত অফিস, দোকানপাট এবং গণপরিবহণ ব্যবস্থা বন্ধ থাকে। কেউ এই নির্দেশিকা মেনে না চললে, তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই ধরণের পরিস্থিতিতে পড়লে আপনি যা করবেন, যা করবেন না- নিচে তা বিস্তারিত দেয়া হল।
১. অত্যন্ত দরকারি না হলে বাড়ি থেকে বেরোবেন না। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন চাল-ডাল, সবজি, মাছ-মাংস কেনা, ওষুধ কেনা, জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসক বা হাসপাতালে যাওয়া।
২. লক ডাউনের মধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে পুলিশের সামনে পড়লে যদি উপযুক্ত কারণ দেখাতে না পারেন তাহলে প্রশাসন কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে।
৩. আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন না। ঘনিষ্ঠ হোন বা দূর সম্পর্কের, আত্মীয়ের বাড়ি বয়কট করুন।
৪. গুজবে কান দেবেন না। এই পরিস্থিতিতে নানা গুজব ছড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে গুজব ছড়ানো এখন সহজ হয়ে গেছে। একেবারে বিশ্বস্ত সূত্র বা সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কোনও কথা বিশ্বাস করবেন না। লক ডাউনের মধ্যে ঔষধের দোকান, মুদি দোকান, সবজির দোকান ও মাছ বাজার খোলা থাকবে। সাধারণ দিনের মতোই মিলবে ডিম ও দুধ।
৫. অসুস্থতা অর্থাৎ জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা বা শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা দিলে কাছাকাছি হাসপাতালে যান। নিজেকে একটি ঘরে বন্দি রাখুন। মাস্ক ব্যবহার করুন। ঘণ্টায় অন্তত ১ বার করে সাবান বা এলকোহলযুক্ত হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোবেন। (এই অংশটি অনলাইন থেকে সংগৃহিত)

করোনার দিনগুলো নিয়ে লেখার আগে এই পর্বটি জনসচেতনতা ও পাঠকদের জানানোর তাগিদে এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হল।

আসছে ২য় পর্ব….

লেখক : সম্পাদক , কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন) , সহকারী অধ্যাপক , কক্সবাজার সিটি কলেজ।